হঠাৎ করেই পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে মডার্ন মিলিটারি ডায়েট প্ল্যান ‘কিটো ডায়েট’ নিয়ে। বাংলাদেশেও এ নিয়ে কথা হচ্ছে। অনেকেই নানারকম ডায়েটের মধ্য থেকে কিটো ডায়েটকে বেছে নিচ্ছেন। দেশে ইউটিউব-ফেসবুকে জনপ্রিয় ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের নানা ডায়েট প্ল্যানের কারণে এ বিষয়টি আরও বেশি জোরালোভাবে সামনে এসেছে।
কিটো ডায়েট কী?
কিটো ডায়েটে মূলত কার্বোহাইড্রেটকে এড়িয়ে চলা হয়। আমাদের শরীরে যে জমাট ফ্যাট থাকে, কোনো কাজের সময় শরীর সেটাকে পোড়ায় না। তুলনামূলকভাবে চর্বি পোড়ানো সহজ হওয়ায় কাজের ক্ষেত্রে শরীর প্রথমে চর্বিকেই পোড়ায়। ফলে এ কার্বোহাইড্রেট আমাদের শরীরে জমাট বেঁধে স্থূলতা তৈরি করে। কিটো ডায়েটের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে কার্বোহাইড্রেটকে পুড়িয়ে ফেলা।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাবার ভাত; যার ৯০ শতাংশই কার্বোহাইড্রেট। অর্থাৎ আমাদের শরীর কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাদ্যে অভ্যস্ত। এটি শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেয়। খাদ্য কিটোজেনিক ডায়েটের মূল ফর্মুলা কার্বোহাইড্রেটকে বাদ দিয়ে ফ্যাট আর প্রোটিনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
আমাদের শরীরের প্রধান খাদ্য বা জ্বালানি হল গ্লুকোজ। কিন্তু যদি কোনো কারণে গ্লুকোজ শেষ হয়ে যায় তবে দেহ একটি বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে। সেই বিকল্প জ্বালানিগুলোকে বলা হয় কিটোন বডি। কিটোন বডি থেকেই এসেছে কিটোজেনিক ডায়েট। কিটোন বডির মধ্যে রয়েছে এসিটোন, এসিটো এসিটিক এসিড এবং বিটা-হাইড্রক্সি-বিউটারেট।
কিটো ডায়েট হল সুপার লো-কার্ব ডায়েট। এ ডায়েটে কার্ব এক্সট্রিম লেভেলে কম থাকবে আর ফ্যাট অনেক হাই থাকবে আর প্রোটিন মিড লেভেলে থাকবে। টিপিক্যাল কিটোজেনিক ডায়েটে টোটাল ক্যালোরিক নিডের কার্ব ৫ শতাংশ, প্রোটিন ২৫ শতাংশ আর ফ্যাট থাকে ৭০ শতাংশ।
মানে আপনি সারা দিন যত খাবার খাবেন তার মধ্যে খাবারের পার্সেন্টেজ এমন হবে। আমাদের নরমাল ডায়েটে ৫০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট থাকে, ২০ শতাংশ প্রোটিন আর ৩০ শতাংশ ফ্যাট থাকে। ধরা যাক আপনি ১২০০ ক্যালরি খাবেন সারা দিনে। তার ৫০ শতাংশ কার্ব মানে আপনাকে ৬০০ ক্যালরির কার্ব খেতে হবে।
কিটো ডায়েট কীভাবে কাজ করে?
অনেক পুষ্টিবিদ অনেকভাবে এটাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সবাই একটাই কথা বলেছেন, কার্বোহাইড্রেটকে বাদ দিয়ে ফ্যাট আর প্রোটিন খাও। সর্বজনস্বীকৃত একটা ফর্মুলা আছে। সেটা হল ৬০ শতাংশ ফ্যাট + ৩০ শতাংশ প্রোটিন + ১০ শতাংশ কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট।
যখন ফ্যাট বার্ন হবে তখন আপনার ওয়েট লস বা ফ্যাট লস হবে, কারণ কিটোতে আপনার ফ্যাট সেল বার্ন হচ্ছে। এখানে প্রোটিন জরুরি কারণ বডি যখন কিটোসিসে যায় তখন ফ্যাটের সঙ্গে কিছু মাসল ও বার্ন করতে পারে, সেটি যেন না হয় বা কম হয় তাই প্রোটিন রাখা হয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে ফ্যাট এত বেশি খাবার প্রয়োজন কী?
কিটো ডায়েটে আমরা মেইনলি প্রোটিন খাব, শুধু প্রোটিন থেকে ডেইলি ক্যালরি রিকোয়ারমেন্ট পূরণ করা যাবে না।
বেশি ক্যালরি বা ক্যালরির ঘাটতিতে যাওয়া যাবে না। কারণ তখন আপনার বডি ঠিকমতো ফাংশন করবে না। সেটি আর হেলদি ডায়েট থাকবে না। টোটাল ক্যালরি নিডের মাত্র ২০-৩০ শতাংশ প্রোটিন আর ৫ শতাংশ কার্ব বাকিটা ফ্যাট দিয়ে চাহিদা পূরণ করতে হবে। কিটো ডায়েটে আমরা ফ্যাট খাব ফ্যাট বার্ন করার জন্য।
কিটো ডায়েট চার প্রকার
১. স্ট্যান্ডার্ড কিটোজনিক ডায়েট : এটাতে কার্ব ৫ শতাংশ, প্রোটিন ২৫ শতাংশ আর ফ্যাট ৭০ শতাংশ থাকে। ২. সাইক্লিক্যাল কিটোজনিক ডায়েট : এ কিটোতে সপ্তাহে দুদিন হাই কার্ব খাওয়া যায়। ৩. টার্গেটেড কিটোজনিক ডায়েট : এ কিটোতে ওয়ার্ক আউটের আগে বা পরে কার্ব খেতে পাওয়া যায়। ৪. হাই প্রোটিন কিটো ডায়েট : এটি অনেকটা স্ট্যান্ডার্ড কিটো ডায়েটের মতোই, শুধু প্রোটিন ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশ হয়ে যায়। এটাতে ফ্যাট ৬০ শতাংশ, প্রোটিন ৩৫ শতাংশ আর ফ্যাট ৫ শতাংশ. বডি বিল্ডার বা এথলেটরা এটি করে থাকে।
কিটো ডায়েট : যেসব খাবার নিষেধ
* চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার বাদ। কোক, ফলের জুস, কেক, আইসক্রিম, চকলেট, স্মুদি, যে কোনো ধরনের মিষ্টি। * আটার তৈরি কোনো কিছু, ভাত, পাস্তা, নুডলস, ওটস, কর্ন ফ্লেক্স সব বাদ। * সব ধরনের ফল নিষেধ। * সব ধরনের ডাল নিষেধ, ডালে প্রোটিনের পাশাপাশি ভালো পরিমাণ কার্ব থাকে।
* মাটির নিচে হয় এমন সব সবজি যেমন- আলু, মুলা, গাজর, কচু সব বাদ। * যে কোনো ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবার একদম বাদ।
কিটো ডায়েট : যেসব খাবার খাওয়া যাবে
গরুর মাংস, মুরগি, সব ধরনের মাছ, ডিম, বাটার, বাদাম, হেলদি ওয়েল। যেমন অলিভ ওয়েল, কোকনাট ওয়েল, ক্যানলা ওয়েল, ঘি, সবুজ যে কোনো সবজি, পালং, ব্রকলি, বাঁধাকপি, মোটামুটি সব ধরনের মসলা।
যে কারণে কিটো ডায়েট
অল্প সময়ে প্রচুর ফ্যাট কমানো যায়। ফ্যাট আর প্রোটিন খাবেন তাই পেট খালি থাকবে না। শরীরে পেশির পরিমাণ কমবে না; কিন্তু মেদ কমে যাবে। অনেক বেশি প্রোটিন থাকাতে সহজে ক্ষুধা লাগবে না। আপনি সহজে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন।
কিছু সতর্কতা
* কার্ব কম হওয়ার কারণে বডি পানি কম হোল্ড করে। তাই শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যায়। প্রতি ১ গ্রাম কার্ব ৩ গ্রাম পানি হোল্ড করে। তাই বডিকে হাইড্রেটেড রাখতে বেশি পানি খেতে হবে। দিনে কমপক্ষে ৩-৪ লিটার। পানি আর মিনারেলের ঘাটতি কমাতে দিনে ১.৫ ২ চা চামচ লবণ সারা দিনের খাবারে খেতে হয়।
* হোল গ্রেন ফুড বন্ধ থাকার কারণে ফাইবার কম হবে। আর ফাইবার কম হলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হবে। সবুজ শাকসবজি, বাদাম, সঙ্গে রাতে ঘুমানোর আগে ১-২ চা চামচ ইসবগুল এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে খেলে অনেকটা সমস্যা কমে যায়।
* ফল আর গ্রেইন ফুড সব বন্ধ করার কারণে শরীর সব ধরনের ভিটামিন, মিনারেল পাবে না সেজন্য আপনাকে মাল্টিভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খেতে হবে সে ঘাটতি পূরণের জন্য। দিনে ১টি ভিটামিন ‘সি’ আর একটি মাল্টিভিটামিন ক্যাপসুল খেতে হবে।
কিটো ডায়েট সম্পর্কে কিছু তথ্য
ভেজিটেরিয়ানদের জন্য কষ্টকর : কিটো ডায়েটে প্রোটিন খুব কম পরিমাণে গ্রহণ করতে হলেও শাকসবজি থেকে সেই প্রোটিন পাওয়াটা খুব কঠিন ব্যাপার। এ ছাড়া সবজিতে আপনি প্রোটিনের সঙ্গে সঙ্গে শর্করাও পাবেন। এটিও আপনার ডায়েটে বিঘ্ন তৈরি করতে পারে।
অতিরিক্ত প্রোটিন নয় : আপনার হয়তো মনে হতেই পারে, কিটো ডায়েট মানেই প্রচুর পরিমাণ মাংস গ্রহণ করা। বাস্তবে ব্যাপারটি একেবারেই এমন নয়। ৭৫ শতাংশ ফ্যাট, ২০ শতাংশ প্রোটিন এবং ৫ শতাংশ কার্ব- মোট মিলিয়ে এভাবেই কিটো ডায়েট সাজানো হয়।
কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে : সাধারণত, আমরা শর্করা জাতীয় খাবার থেকেই আঁশ পেয়ে থাকি। এতে করে আমাদের খাবার হজম থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজগুলো সহজ হয়ে পড়ে।
কিটোর ডায়েটের সঠিক উদ্দেশ্য : ওজন কমানো নয়, সিজার সংক্রান্ত নানারকম শারীরিক সমস্যা দূর করার জন্য এ ডায়েট ব্যবহার করা হয়। বাচ্চাদের মধ্যে এপিলেপ্সি ও এমন অন্যান্য ডিজঅর্ডার সারিয়ে তুলতে প্রায় এক শতক আগে কিটো ডায়েট তৈরি করা হয়।
ফল মানেই ‘না’: কিটো ডায়েটে আপনি ফল খেতে পারবেন না খুব একটা। সাধারণত অন্যান্য ডায়েটে ফলের জায়গাটুকু থাকলেও কিটো ডায়েটে সেটা প্রায় নেই বললেই চলে।